মঙ্গল কামনা ও রোগব্যাধী থেকে মুক্তি পেতে প্রায় দুইশ' বছর ধরে নাটোরের শংকরভাগ গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চড়ক মেলা। দিনব্যাপী এ মেলায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সমাগমে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে শুরু এ মেলা চলছে মধ্যরাত পর্যন্ত।]ঐতিহাসিক এই মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের কয়েক গ্রামজুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ। বাড়িতে বাড়িতে চলে মাংস, বিরিয়ানী, পিঠা, পায়েস, সেমাইসহ নানা পদের খাবারের আয়োজন।
মানুষের পিঠের সঙ্গে কালা বা বর্শি বিধিয়ে ঘোরানোই এ মেলার ঐতিহ্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাসনা পূর্ণ করতে নানা রকম ফল, হাঁস-মুরগি ও ছাগল মানত করে পূজা অর্চনা করে। এদিন সকাল থেকে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। দুর-দুরান্ত থেকে আসতে থাকে দর্শনার্থীরা। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পদচারণায় মেলা কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।
পাবনা থেকে মেলায় ঘুরতে আসা রুপক কুমার বলেন, প্রতিবছর এই চড়ক মেলায় পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসি। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় অনেক মানুষ আসে। বৈশাখের ১ তারিখে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষের পিঠের সঙ্গে কালা বা বর্শি বিধিয়ে ঘোরানো। এ কারণে কৌতুহলে অনেক মানুষ আসেন দেখতে।
স্থানীয় বাসিন্দা কমর দাস বলেন, হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের আয়োজনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে মানত করে নানা কিছু নিয়ে আসেন। বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছরই চড়ক পূজায় মেলা বসে। অনেক দূরের মানুষ এ মেলায় ঘুরতে আসেন।
রতন প্রমানিক নামে আরেকজন বলেন, এলাকার প্রায় দেড়শ' আদিবাসী বাড়ি ছাড়াও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র মাসের শেষ দিনে এ চড়ক মেলার আয়োজন করে। মেলাকে কেন্দ্র করে নানা খাবারের দোকানের পসরা বসে। আত্মীয়-স্বজনরা বাড়িতে বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এতে আনন্দময় এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।পাবনা থেকে মানত করে আসা বিথী রানী বলেন, আমার ৩ বছরের সন্তান অসুস্থ্য। অনেক চিকিৎসা করিয়েও কোনো সুফল পাইনি। তাই এ চড়ক মেলায় সন্তানের জন্য মানত করতে এসেছে। এখানে অনেকে এসে রোগমুক্ত হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা স্বপ্না রানী বলেন, আমার ১০ বছর থেকে কোনো সন্তান হয় না। এখানে এসে মানত করেছি। আমার এক বোনের এখানে মানত করে সন্তান হয়েছে। তাই এখানে মানতের উদ্দেশ্যে এসেছি। পুরো মেলা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।শংকরভাগ চড়ক পূঁজা উদযাপন কমিটির সভাপতি হারান চন্দ্র গোস্বামী বলেন, গত প্রায় দুইশ' বছর থেকে আমাদের বাপ-দাদারা এ মেলার আয়োজন করে আসছে। তার ধারাবাহিকতায় এ বছরেও হচ্ছে। অনেক জেলা থেকে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আসে। অনেকে মানত করেন, তাদের মানত পূর্ণ হয়। ২১ সদস্য বিশিষ্ট মেলা পরিচালনা কমিটি রয়েছে। এছাড়াও যেন কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তৎপর ছিলেন।
নাটোর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আখতার জাহার সাথী ‘আমাদের সময়’কে বলেন, চড়ক ঘোরানো গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। আগের মতো আর তেমন অনুষ্ঠিত হয় না। প্রায় বিলুপ্তের পথে এ চড়ক। স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের আয়োজনে মেলাটি হয়ে থাকে। চড়ককে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকায় উৎসবে পরিণত হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে ছিলেন। সেই সাথে আগামী বছর থেকে মেলার নিরাপত্তার জন্য পুলিশের ক্যাম্প বসানো হবে। সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।